ফেনীর গর্বঃ মোহাম্মদ আলী চৌধুরী জামে মসজিদ
॥ এ কে এম গিয়াস উদ্দিন মাহ্মুদ ॥
কোম্পানীর রাজত্বের শুরুতে তাদের সীমাহীন জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপোশহীন সংগ্রাম করে ফেনীর এক বীর সন্তান ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন; তার নাম মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। তিনি ছিলেন দাঁদরা -এলাহাবাদ পরগনার বিখ্যাত জমিদার ও বিশিষ্ট সাধক পুরুষ আল্লামা ফাজেল মোহম্মদ চৌধুরীর বংশধর। তার পিতার নাম ছিল ফতেহ মুহাম্মদ চৌধুরী। মোহাম্মদ আলী চৌধুরী ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা বীর পুরুষ। তিনি ফেনী তথা নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ উৎপাদনকারী ও কৃষক প্রজাদের উপর কোম্পানীর আমলা ও দালালদের অত্যাচারের প্রতিবাদে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অবশেষে “নবাব মীর কাশেম ১৭৬২ সালে মোহাম্মদ আলী চৌধুরীকে নবাবের প্রতিনিধি তথা নায়েবে আমির হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি ইংরেজ বেনিয়াদের নিকট থেকে বিগত কয়েক বছরে (জুলাই ১৭৫৭ সাল থেকে জুন ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত) বকেয়া শুল্ক ও অন্যান্য ‘কর’ দাবি করেন। শুধু তাই নয়, তিনি ইংরেজ কুঠিয়ালদের আটক করতে থাকেন এবং তাদের কুঠিতে প্রাপ্ত মালামাল বাজেয়াপ্ত করতে থাকেন। কুঠিয়ালগণ দিশেহারা হয়ে শেষ পর্যন্ত গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের শরাণাপন্ন হতে থাকেন। কিন্তু মোহাম্মদ আলী নিজের জমিদারি স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে নবাব মীর কাশিম পরাজিত ও ক্ষমতাচ্যুত হলে মোহাম্মদ আলীর জীবনে দুর্যোগ নেমে আসে। ১৭৬৫ সালে দিল্লীর বাদশাহের নিকট থেকে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা “দেওয়ানী” রাজস্ব গ্রহণ করার পরও তিনি কোম্পানীর রাজকোষ হতে খাজনা প্রদানে অস্বীকার করেন। ফলে দাদরাস্থ তাঁর জমিদারি খাসে চলে যায়। সরকারি কাগজপত্রে তাঁর জমিদারি খাস হয়ে গেলেও মোহাম্মদ আলী বহুদিন স্বীয় এলাকার উপর প্রাধান্য বজায় রেখেছিলেন। পারস্পরিক ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি ছিলেন একজন প্রজাদরদি জমিদার। কোম্পানী রাজত্বের প্রথম দিকে বাংলাদেশে সংঘটিত মহা দুর্ভিক্ষ বা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় জমিদার মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্থানীয় মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তাঁর বিপুল ধন-সম্পদ উদারহস্তে দান করে দেন।
শর্শাদীর নিমতলীতে জমিদার মোহাম্মদ আলী চৌধুরী নির্মিত বসতবাড়ি এখনও রয়েছে। তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ বংশধর ছিল না। তার বসতবাড়ির সামনে ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট পাকা মসজিদ, তার উদ্যোগে খননকৃত বিশাল একটা দীঘি এবং তার নামে পরিচিত মোহাম্মদ আলী বাজার (ফেনী-কুমিল্লা সড়কের পাশে) এখনো তার স্মৃতি বহন করছে। জমিদার মোহাম্মদ আলী আজীবন ইংরেজ কোম্পানীর আমলাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। স্থানীয় কৃষকদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ বহু চেষ্টা করেও দীর্ঘদিন তাঁকে গ্রেফতার করতে পারেনি। অবশেষে তাঁর দেওয়ান নুর মুহাম্মদের পুত্র গাউস মুহাম্মদ ও ওয়াসেক মুহাম্মদ জমিদারি লাভের আশায় মোহাম্মদ আলী চৌধুরীকে ধরিয়ে দেয়। তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের বিচার চলাকালে তিনি ১৭৯৩ সালে ইন্তেকাল করেন। কারো কারো মতে তিনি কোম্পানীর বিচার মানতে অস্বীকার করে আত্মহত্যা করেছিলেন।
মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর অনন্য সৃষ্টি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী জামে মসজিদ। মসজিদটি ফেনী জেলার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ। এটি ১১০০ হিজরিতে নির্মিত। সেই হিসেবে মসজিদটির বর্তমান বয়স ৩৩৮ বছর। মূল মসজিদটির দৈর্ঘ ৩৬ ফুট, প্রস্থ ২০ ফুট এবং কার্ণিশ বরাবর উচ্চতা ১৬ ফুট। মসজিদটিতে ৩টি দরজা ও ২টি জানালা বিদ্যমান। প্রধান দরজাটি বাম ও ডানের দরজা দু’টি হতে একটু বড়। প্রধান দরজার উপরে কষ্টি পাথরের উপরে আরবি হরফে লেখা একটি ফলক রয়েছে। মসজিদের কার্ণিশ বরাবর ফুলের পাপড়ি সদৃশ নকশা বিদ্যমান।
আবার কার্ণিশ হতে উপরের চতুর্দিকে সরু আকৃতির মোট ৮টি মিনার রয়েছে। মিনারের উপরে ছোট ছোট বল আকৃতির দু’টি ও একটি ফুলের কলি সদৃশ্য নকশা বিদ্যমান। প্রায় ৪ ফুট পুরু মসজিদের মূল আকর্ষণ এর ৩টি গম্বুজ। মাঝের গম্বুজটি ডান-বাম দিকের গম্বুজের চেয়ে একটু বড়। গম্বুজগুলো বহিঃভাগের কেন্দ্র বরাবর ফুলের পাপড়ি, বল এবং ফুলের কলি সদৃশ্য নকশা রয়েছে। আবার অভ্যন্তরের দেয়ালে সুন্দর সুন্দর নকশা ও উলটো ইউ আকৃতির পশ্চিমে ৮টি, পূর্বে ৬টি, উত্তরে ২টি এবং দক্ষিণে ২টি। তথা সর্বোমোট ১৮টি নকশা বিদ্যমান। অবশ্য মসজিদের পূর্ব দিকে বহিঃদেয়ালেও অনুরূপ ৩টি নকশা রয়েছে। গম্বুজ গুলোর ভিতরে কার্ণিশ বরাবর ফুলের পাপড়ি সদৃশ্য নকশা বিদ্যমান। মসজিদের বহিঃভাগ খয়রি ও অভ্যন্তর ভাগ সাদা রং করা বলে অনেক বেশি দৃষ্টিনন্দন। মসজিদের পূর্বে আযান দেয়ার স্থান এবং উত্তর-দক্ষিণে সুন্দর গোল আকৃতির ২টি কক্ষ রয়েছে। কক্ষগুলো ইমাম এবং মুয়াজ্জিনের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। অবশ্য কক্ষগুলো পরিত্যক্ত রয়েছে। মূল মসজিদে স্থান সংকুলান হয় না বলে ৮র্০ী৬র্০ আয়তনের সম্প্রসারিত আরেকটি ভবন সংযুক্ত করা হয়েছে। সম্প্রসারিত ভবনটি দ্বিতলা। এতে ৮টি স্তম্ভ, ৪০টি জানালা, ২টি বড় জানালা, ২টি বড় দরজা, ৮টি ছোট দরজা এবং বহিঃভাগে একটি সুদৃশ্য গম্বুজ রয়েছে। সাদা রংয়ের সম্প্রসারিত মসজিদের ভবন ও গম্বুজটি খুবই সুন্দর।
এসুন্দর সম্প্রসারিত মসজিদটি নির্মাণে যারা অর্থ দান করেছেন তারা হলেন আবু রাশেদ, মারবুক, ছুত্তয়ানি যারওয়ান আল আযেমী এবং তাঁর স্ত্রী যুহাইয়া ঈদ। এরা দু’জনে কুয়েতের অধিবাসী। সম্প্রসারিত মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর ৩ এপ্রিল ১৯৮৬ সালে স্থাপিত হয়। এ দৃষ্টিনন্দন মসজিদের আড়ালে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী মোহাম্মদ আলী চৌধুরী জামে মসজিদ। ঐতিহ্য ধ্বংস না করে তা রক্ষণাবেক্ষণ করার এ এক অনুপম নিদর্শন।
মসজিদের চারদিকে আল-জামিয়াত, আল-ইসলামিয়া, দ্বারুল উলুম মাদ্রাসার দ্বিতল কয়েকটি ভবন রয়েছে। এটি ফেনী জেলার একটি প্রসিদ্ধ মাদ্রাসা। ১৯৪৩ সালে মাদ্রাসাটি স্থাপিত। প্রজাদরদি জনহিতৈষী হিসেবে যেমন মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর কথা সবাই স্মরণ করে, তেমনি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী জামে মসজিদটিও তাঁর স্মৃতি ধারণ করে আছে। তাঁর সৃষ্টি, তাঁর কীর্তি ফেনী জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধন, গর্বের সম্পদ।