Sun Mercury Venus Ve Ves
বিশেষ খবর
‘লক্ষী’ থেকে লক্ষীপুর, যার আরেক নাম সয়াল্যান্ড  লক্ষীপুর জেলা পরিষদের উদ্যোগে ৫০ মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা  ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুল শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ  আ’লীগ আবারও ভোট চুরির পরিকল্পনা করছে - লক্ষীপুরে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী  শ্রীলঙ্কার অবস্থা দেখে বাংলাদেশে দিবাস্বপ্ন দেখার কোনো কারণ নেই - লক্ষীপুরে মাহবুব উল আলম হানিফ 

নোয়াখালী জেলার ইতিহাস

নোয়াখালী জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। নোয়াখালী জেলা আগে ফেনী, লক্ষ্মীপুর এবং নোয়াখালী সদর মহকুমা নিয়ে একটি বৃহত্তর অঞ্চল ছিল, যা এখনও বৃহত্তর নোয়াখালী নামে পরিচিত।
ভৌগলিক সীমানা
চট্টগ্রাম প্রশাসনিক বিভাগের অধীন নোয়াখালী জেলার মোট আয়তন ৩৬০১ বর্গ কিলোমিটার। নোয়াখালী জেলার উত্তরে কুমিল্লা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলা এবং পশ্চিমে লক্ষ্মীপুর ও ভোলা জেলা অবস্থিত। বছরব্যাপী সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় ৩৪.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় ১৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বছরে গড় বৃষ্টিপাত ৩৩০২ মি.মি.। এই জেলার প্রধান নদী বামনি এবং মেঘনা।
প্রশাসনিক এলাকাসমূহ
নোয়াখালী জেলায় ৯টি উপজেলা রয়েছে। এগুলো হলোঃ নোয়াখালী সদর, বেগমগঞ্জ, চাটখিল, কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া, সেনবাগ, কবির হাট, সুবর্ণ চর, সোনাইমুড়ি।
প্রশাসনিক বিন্যাস
নোয়াখালী জেলার মর্যাদা পায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক এদেশে জেলা প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় থেকেই। ১৭৭২ সালে কোম্পানীর গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এদেশে প্রথম আধুনিক জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা নেন। তিনি সমগ্র বাংলাদেশকে ১৯টি জেলায় বিভক্ত করে প্রতি জেলায় একজন করে কালেক্টর নিয়োগ করেন। এ ১৯টি জেলার একটি ছিল কলিন্দা। এ জেলাটি গঠিত হয়েছিল মূলতঃ নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে। কিন্ত ১৭৭৩ সালে জেলা প্রথা প্রত্যাহার করা হয় এবং প্রদেশ প্রথা প্রবর্তন করে জেলাগুলোকে করা হয় প্রদেশের অধীনস্থ অফিস। ১৭৮৭ সালে পুনরায় জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং এবার সমগ্র বাংলাদেশকে ১৪টি জেলায় ভাগ করা হয়। এ ১৪টির মধ্যেও ভুলুয়া নামে নোয়াখালী অঞ্চলে একটি জেলা ছিল। পরে ১৭৯২ সালে ত্রিপুরা নামে একটি নতুন জেলা সৃষ্টি করে ভুলুয়াকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮২১ সালে ভুলুয়া নামে নোয়াখালী জেলা প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চল ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী মহকুমা নিয়ে নোয়াখালী জেলা গঠিত হয়। এটি চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত একটি বিশাল জেলা হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছিল। ১৯৮৩ সালে সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক সকল মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হলে লক্ষ্মীপুর ও ফেনী জেলা আলাদা হয়ে যায়। শুধুমাত্র নোয়াখালী মহকুমা নিয়ে নোয়াখালী জেলা পুনর্গঠিত হয়। তখন এ জেলায় উপজেলা ছিল ছয়টি। পরবর্তীতে আরো তিনটি উপজেলা সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে জেলায় মোট উপজেলার সংখ্যা নয়টি। জেলার একটি বিশেষত্ব হলো আটটি উপজেলা মূল ভূখন্ডের সাথে রয়েছে। আর হাতিয়া নামক উপজেলাটির কিছু অংশ জেলার মূল ভূখন্ডের সাথে সংযুক্ত থাকলেও বৃহত্তর অংশ (মূল হাতিয়া) এর চতুর্দিকে মেঘনা নদী দ্বারা বেষ্টিত একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা। নিঝুম দ্বীপ নামে একটি প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রয়েছে হাতিয়া উপজেলার অধীনে, যা পর্যটকদের কাছে খুব আকর্ষণীয়।
নোয়াখালী জেলার শহর
নোয়াখালী সদর মাইজদি ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। শহরের মোট জনসংখ্যা ৭৪,৫৮৫ জন; এর মধ্যে ৫১.৫০% পুরুষ এবং ৪৮.৫০% মহিলা; জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫৯১৫ জন। শহুরে লোকদের মধ্যে শিক্ষিতের হার প্রায় ৬০.৭০%। নোয়াখালী শহরের আদি নাম সুধারাম। ১৯৪৮ সালে যখন উপজেলা সদর দফতর মেঘনা গর্ভে বিলীন হয়ে যায়, তখন তা ৮ কিলোমিটার উত্তরে সরিয়ে বর্তমান মাইজদিতে স্থানান্তর করা হয়।
চৌমুহনী নোয়াখালীর আরেকটি ব্যস্ত শহর ও প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র, যা একসময়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনা ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল। আরও বিখ্যাত ছিল ঘানিভাঙ্গা সরিষার তেলের জন্য। বসুরহাট শহরটি দ্রুত বেড়ে উঠছে এবং ব্যস্ত শহরের রূপ নিচ্ছে । এই শহরের অধিবাসীদের একটি বড় অংশ জীবিকার অন্বেষণে ইউকে, আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। সম্ভবত এই জন্যেই এখানে বাড়ি এবং জমির দাম খুবই বেশি, প্রায় রাজধানী ঢাকার সমপরিমাণ।
বসুরহাট হতে ৮ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে চৌধুরীহাট নামে আরেকটা বাজার আছে, যা কিনা বর্তমানে ঐ এলাকার মোটামুটি দ্রুত উন্নয়নশীল এলাকা হিসেবে পরিচিত। মূূলত এই চৌধুরী হাট বাজার চরপার্বতী গ্রামে অবস্থিত। এই গ্রাম পুরো ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। চরপার্বতী গ্রামের চৌধুরী হাট বাজারের বিখ্যাত হাই স্কুল ‘চৌধুরী হাট উচ্চ বিদ্যালয়’ এই বাজারে অবস্থিত। এছাড়া এই গ্রামে আরও অনেকগুলো হাইস্কুল আছে যেমন-কদমতলা হাই স্কুল, মেহেরুন্নিসা হাই স্কুল, চৌধুরী হাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এই ছাড়া কয়েকটা প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে যেমন- উত্তর চরপার্বতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (খাঁয়ের গো স্কুল), দক্ষিণ চরপার্বতী প্রাথমিক বিদ্যালয় (জংল্যা স্কুল), চৌধুরী হাট প্রাথমিক বিদ্যালয়, জনতা বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেকগুলো।
ইতিহাস
নোয়াখালীর ইতিহাসের অন্যতম ঘটনা ১৮৩০ সালে এ জেলার জনগণের জিহাদ আন্দোলন ও ১৯২০ সালের খিলাফত আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ। জাতিগত সংঘাত ও রায়টের পর ১৯৪৬ সালে মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলা ভ্রমণ করেন। বর্তমান বেগমগঞ্জ উপজেলার জয়াগ নামক স্থানে গান্ধীজির নামে একটি আশ্রম রয়েছে, যা "গান্ধী আশ্রম" নামে পরিচিত।
১৭৯০ সালের পর হতে নোয়াখালী জেলা বহুবার ঘুর্ণিঝড়, বন্যা, টর্নেডো, সাইক্লোন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত হয়। ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ১০ লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটে, যার মধ্যে নোয়াখালী জেলার অনেকে ছিলেন। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নোয়াখালীর মাটি রঞ্জিত হয়েছে। ১৫ জুন, ১৯৭১ সালে সোনাপুর আহমদীয়া স্কুলের সম্মুখ যুদ্ধে প্রায় ৭০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। ১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট পাকবাহিনী বেগমগঞ্জ থানার গোপালপুরে গণহত্যা চালায়। নিহত হন প্রায় ৫০ জন নিরস্ত্র মানুষ। নোয়াখালী জেলা স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর।
অর্থনীতি
নোয়াখালী জেলার মোট আয় ৩৭৮ কোটি টাকা (১৯৯৯-২০০০)। জেলার মোট আয়ের ৪৮% আসে চাকরি বা সেবামূলক খাত থেকে। অপরদিকে আয়ের মাত্র ১৭% আসে শিল্পখাত থেকে। নোয়াখালী জেলার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬ শতাংশ হারে হচ্ছে। নোয়াখালী জেলার মানুষের মাথা পিছু আয় ১৩,৯৩৮ টাকা (১৯৯৯-২০০০)।
নোয়াখালী জেলার কৃতী সন্তান
কমরেড মোজাফফর আহমদ, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, নুরুল হক, প্রফেসর আলী আহমদ, বীর সৈনিক সার্জেন্ট জহুরুল হক, বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন, মওদুদ আহমেদ, মুনীর চৌধুরী, ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের, ফেরদৌসী মজুমদার, ফেরদৌস আরা, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, উপাচার্য ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী প্রফেসর মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আবদুশ শাকুর, শিল্পপতি হারুনুর রশিদ, আনোয়ার মীর্জা, ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, ড. মাযহারুল হক, ড. খলিলুর রহমান, রফিকুল্লাহ চৌধুরী, ড. সা’দত হোসাইন, প্রতিরক্ষা সার্ভিসে এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, পুলিশের আইজি (পরবর্তীতে সচিব) এ এস এম শাহজাহান।
বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার মুক্তিযোদ্ধা
বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন, সফি উল্যাহ, খিজির হায়াত খান, আবু নাছের, নূরুল আলম প্রমুখ।
জনসংখ্যা
নোয়াখালী জেলার মোট জনসংখ্যা ৩১,০৮,০৮৩ (পুরুষ- ১৪,৮৫,১৬৯ এবং মহিলা- ১৬,২২,৯১৪)। পুরুষ এবং মহিলার অনুপাত ৯২ঃ১০০, জনসংখ্যার ঘনত্ব ৮৪৩ বর্গ কিলোমিটার এবং জন্মহার ১.৮৩%।
নামকরণ
নোয়াখালী জেলার প্রাচীন নাম ছিল ভুলুয়া। নোয়াখালী সদর থানার আদি নাম সুধারাম। ইতিহাসবিদদের মতে একবার ত্রিপুরার পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর পানিতে ভুলুয়া-র উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহভাবে প্লাবিত হয় ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে ১৬৬০ সালে একটি বিশাল খাল খনন করা হয়, যা পানির প্রবাহকে ডাকাতিয়া নদী হতে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা এবং ফেনী নদীর দিকে প্রবাহিত করে। এই বিশাল নতুন খালকে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় ‘নোয়া (নতুন) খাল’ বলা হতো, এর ফলে ‘ভুলুয়া’ নামটি একসময়ে পরিবর্তিত হয়ে ১৬৬৮ সালে হয়ে যায় ‘নোয়াখালী’।
চিত্তাকর্ষক স্থান
নিঝুম দ্বীপ-হাতিয়া, এটি নোয়াখালী জেলার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত;
শহীদ ভুলু স্টেডিয়াম- আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু;
বজরা শাহী মসজিদ- বজরা;
লুর্দের রাণীর গীর্জা- সোনাপুর;
গান্ধি আশ্রম- জয়াগ, সোনাইমুড়ি;
ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল- চর জব্বর;
নোয়াখালী জেলা জামে মসজিদ- মাইজদী;
নোয়াখালী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার- মাইজদী;
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোঃ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর- সোনাইমুড়ি;
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুরের আশ্রম- চৌমুহনী।