Sun Mercury Venus Ve Ves
বিশেষ খবর
‘লক্ষী’ থেকে লক্ষীপুর, যার আরেক নাম সয়াল্যান্ড  লক্ষীপুর জেলা পরিষদের উদ্যোগে ৫০ মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা  ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুল শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ  আ’লীগ আবারও ভোট চুরির পরিকল্পনা করছে - লক্ষীপুরে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী  শ্রীলঙ্কার অবস্থা দেখে বাংলাদেশে দিবাস্বপ্ন দেখার কোনো কারণ নেই - লক্ষীপুরে মাহবুব উল আলম হানিফ 

লক্ষ্মীপুর জেলার ৪ বারের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, নিবেদিত শিক্ষাব্রতী রূপালী প্রভা নাথ

লক্ষ্মীপুর সরকারি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে রূপালী প্রভা নাথ বলেন, লক্ষ্মীপুর সরকারি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকাকালীন জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ায় সত্যিই আমি আনন্দিত। আমার নিকট এটি গর্বের বিষয়। আমি বিগত ২০০৪-২০০৫ সালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলাম। তবে তখনকার অনুভূতি আর বর্তমান সময়ের অনুভূতি ভিন্ন আঙ্গিকের, কারণ তখন গণমাধ্যম ব্যবস্থা এত সক্রিয় ছিল না। এখন আমার এই সু-খবর আমার অভিভাবকগণ, ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করে আমাকে উল্লসিত করেছেন, উৎসাহিত করেছেন, আমার কাছে এই স্মৃতি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
অন্য অনেক পেশা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিলেন কেন, এ পেশায় আসতে কারো অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কী এমন প্রশ্নে নিষ্ঠাবান শিক্ষক রূপালী প্রভা নাথ বলেন, পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমি মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার বাসনা নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় এসেছি। কারণ আমার শ্বশুর এবং ভাসুর শিক্ষক ছিলেন। আমার স্বামীর অনুপ্রেরণা এতে কম ছিল না, কারণ উনিও উনার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে। লক্ষ্মীপুর সরকারি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ঘিরে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানাবেন কী এমন জিজ্ঞাসার জবাবে শিক্ষানুরাগী সমাজসেবী রূপালী প্রভা নাথ বলেন, লক্ষ্মীপুর সরকারি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ঘিরে আমার অনেক স্বপ্ন। এই বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মানসম্মত শিক্ষা দিয়ে তাদের সামনের পথ সুগম করা আমার উদ্দেশ্য। ছাত্র-ছাত্রীদের শুধু লেখাপড়ায় সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না।
তারা খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যেন এগিয়ে চলে। এছাড়া আদব-কায়দা, ভদ্রতা-সভ্যতা, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা আমার উদ্দেশ্য। বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামোর ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষকদের সুন্দর একটি অফিস কক্ষ, উপকরণ কক্ষ, পাঠাগার, খেলার মাঠ, অভিভাবকদের বসার স্থান, মানসম্মত শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদা টয়লেট, নামাজের সুব্যবস্থা, ফুলের বাগান, আলাদা একটি বড় গেইট দ্বারা একটি আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা আমার স্বপ্ন।
প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর স্কুলের সার্বিক কার্যক্রমে কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নে আশাবাদী শিক্ষক রূপালী প্রভা নাথ বলেন, আমি অত্র বিদ্যালয়ে ২০০২ সালের ২৪ অক্টোবর প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। অত্র বিদ্যালয়ে যোগদানের পর বহু অনিয়ম আমার চোখে ধরা পড়ে, কিন্তু আমি কাউকে কিছু না বলে শুধু ঙনংবৎাব করেছি। আমি বিশ্বাস করি, কারো থেকে কিছু পেতে হলে অপেক্ষা করতে হয়। জোর করে কিছু পাওয়া যায় না। তাই দীর্ঘ ২ বছর প্রচুর পরিশ্রম করে শিখন-শেখানো কার্যক্রম হতে সার্বিক কার্যক্রমে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন
শিক্ষক পদ সংখ্যা ২০০২ সালে ছিল ১০ জন, বর্তমানে ১৪ জন। শিক্ষক-শিক্ষিকাগণের শ্রদ্ধা ও সৌজন্যবোধ অনেক ভালো। তাদের নিয়মানুবর্তিতা উল্লেযোগ্য। বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ২০০২ সালে খাতা-কলমে যা ছিল, তার ৩ ভাগের ১ ভাগ ছিল ভুয়া; কিন্তু বর্তমানে আমি ছাত্র-ছাত্রী জায়গা দিতে পারছি না। প্রতিবছর প্রায় ৩০০ ছাত্র-ছাত্রী বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ভীড় করে।
পূর্বে ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি ছিল কম, এ ব্যাপারে অভিভাবককে ডাকলে অভিভাবকগণ উপস্থিত হতেন না। যারা আসতেন তারা শিক্ষকদের অনেক মন্দ কথা শুনিয়ে দিতেন। বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীর গড় উপস্থিতি ৯৫%-৯৮%। প্রতিদিন প্রায় ১০০ জন অভিভাবক বিদ্যালয়ে আসেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে অনেক নমনীয়ভাবে কথা বলেন। আর ফলাফলের কথা বলতে গেলে পূর্বে মোট ছাত্র-ছাত্রীর ২০% বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও ১০০% পাস করতেন না। বৃত্তি ২,৩,৪ জন পেত। কিন্তু ২০০৪ সাল থেকে বৃত্তি, সমাপনী পরীক্ষায় ১০০% পাস এবং ২০০৪-২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর বৃত্তি প্রাপ্তের সংখ্যা গড়ে ১৭ জন। সাংস্কৃতিক কার্যক্রম সম্পর্কে বলা যায়, লক্ষ্মীপুর সরকারি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করে, যা দর্শকদের চমকে দেয়। তারা প্রতিযোগিতার বিভিন্ন বিভাগে ১ম, ২য়, ৩য় স্থান অধিকার করে আসছে।
খেলাধুলা সম্পর্কে বলা যায় অত্র বিদ্যালয়ের শিশুদের খেলাধুলা করার মতো কোনো মাঠ নেই, তথাপি বিভিন্ন খেলাধুলায় তারা গৌরবের সাথে সাফল্য অর্জন করে আসছে। ২০১৬ সালে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা গোল্ডকাপে অত্র বিদ্যালয় রানার্সআপ হবার গৌরব অর্জন করেছে। লক্ষ্মীপুরের শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় বলে আপনি মনে করেন এমন প্রশ্নে সমাজ উন্নয়নে চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব রূপালী প্রভা নাথ বলেন, দিন দিন শিক্ষিত বেকার যুবকদের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে ফল দাঁড়াবে যুবকদের মধ্যে অনেকে বিপথে চলে যাওয়া। সুতরাং সরকারের উচিত নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। আমাদের সকলের উচিত বেকার যুবকদের কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা, কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা। যেমন কয়েকজন মিলে একটি কুঠির শিল্প গড়ে তোলা, খামার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া।
বর্তমান সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা বলবেন কী এমন প্রশ্নে সচেতন শিক্ষক রূপালী প্রভা নাথ বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সফলতা অনেক, শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষার মান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার দৃঢ়তা নিয়ে সরকার এগিয়ে চলছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সর্বপ্রথম ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারিকরণ করেন। যার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে অসাধারণ পরিবর্তন ঘটেছে। সার্থকতার সাথে ব্যর্থতা নাই এটি অস্বীকার করা যাবে না, কারণ প্রত্যেক বিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধার সমবন্টন হচ্ছে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই, বিদ্যালয় গৃহ নেই। দেখা যায়, খোলা মাঠে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। কোমলমতি শিশুদের সুন্দর পরিবেশ ছাড়া কোনো অবস্থাতেই সুন্দর পৃথিবী গড়া সম্ভব নয়।
ছাত্র-যুব সমাজের বিপথগামিতা রোধে পরিবার বা সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে একজন শিক্ষক হিসেবে আপনার সু-পরামর্শ জানাবেন কী এমন প্রশ্নে ছাত্রবৎসল শিক্ষক রূপালী প্রভা নাথ বলেন, যুব সমাজের বিপথগামিতা একটি ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এজন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি বিনোদনের ব্যবস্থা, খেলাধুলা, ডিবেটিং সোসাইটির ব্যবস্থা একান্ত আবশ্যক। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব এবং মাদক-আসক্তির সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে যুবসমাজ দিন দিন বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শিক্ষক হিসেবে আমাদের উচিত শিশু অবস্থা থেকে তাদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা, বর্তমানে আর্থিক দিক থেকে প্রায় পরিবারই সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বিদেশি টাকার প্রভাবে পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন হেতু ছাত্রদের কাছে টাকা সহজেই চলে আসে বিধায় তারা যত্রতত্র নিজকে বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। সেজন্য শিক্ষক এবং পারিবারিক যৌথ প্রচেষ্টায় যুব-সমাজের বিপথগামিতা রোধ করতে হবে।
বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলকে শতভাগ শিক্ষিত এলাকায় পরিণত করতে কী ব্যবস্থা নিতে হবে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নে দূরদর্শী শিক্ষক রূপালী প্রভা নাথ বলেন, বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলকে শতভাগ শিক্ষিত এলাকায় পরিণত করতে হলে প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি, কিন্ডার গার্টেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থাকে একমুখী করতে হবে।
শিশু জরিপের মাধ্যমে (৫+-১০+) সকল ভর্তিযোগ্য শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে ৫ম শ্রেণি শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রেরণ করা প্রত্যেক শিক্ষকের কর্তব্য। তারপর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের দশম শ্রেণি পর্যন্ত ধরে রাখার সুব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া শিক্ষিত বেকার বয়স্কদের জন্য সন্ধ্যাকালীন শিক্ষা-ব্যবস্থা চালু করা যায়। এই শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য শিক্ষিত বেকার যুবকদের কাজে নিয়োগ দেয়া, এতে বেকার যুবকদের সাময়িক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে এবং নোয়াখালী অঞ্চল শতভাগ শিক্ষিত এলাকায় পরিণত হবে।
সুদীর্ঘ ৩০ বছর থেকে নিয়মিত প্রকাশিত বৃহত্তর নোয়াখালীর মুখপত্র লক্ষ্মীপুর বার্তা সম্পর্কে তাঁর মতামত বা সুপারিশ জানতে চাইলে এলাকাপ্রেমী শিক্ষক রূপালী প্রভা নাথ বলেন, বৃহত্তর নোয়াখালীর মুখপত্র লক্ষ্মীপুর বার্তা’র উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করছি। লক্ষ্মীপুর বার্তা জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে একজন অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তবে বর্তমান সময়ের অবক্ষয় ও এর প্রতিরোধের জন্য কিছু পদক্ষেপ লক্ষ্মীপুর বার্তা’র নেয়া উচিত। এমন সব প্রবন্ধ, নাটক, গল্প, এতে স্থান পাওয়া উচিত -যাতে বেকার যুবকদের বেকারত্ব ঘোচাবার সহায়ক হয় ও প্রেরণা যোগায়।
সাক্ষাৎকারঃ জাহাঙ্গীর লিটন
প্রতিবেদনঃ মোহাম্মদ মোস্তফা