Sun Mercury Venus Ve Ves
বিশেষ খবর
‘লক্ষী’ থেকে লক্ষীপুর, যার আরেক নাম সয়াল্যান্ড  লক্ষীপুর জেলা পরিষদের উদ্যোগে ৫০ মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা  ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুল শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ  আ’লীগ আবারও ভোট চুরির পরিকল্পনা করছে - লক্ষীপুরে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী  শ্রীলঙ্কার অবস্থা দেখে বাংলাদেশে দিবাস্বপ্ন দেখার কোনো কারণ নেই - লক্ষীপুরে মাহবুব উল আলম হানিফ 

আষাঢ়েও আশাহত লক্ষ্মীপুরের জেলেরা

এখন আষাঢ় মাস, চলছে অবিরাম বৃষ্টি। এ ভরা মৌসুমেও লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে ইলিশের আকাল চলছে। জ্যৈষ্ঠ থেকে ইলিশের মৌসুম শুরু হলেও আষাঢ়েও দেখা মিলছে না ইলিশের! জোয়ারের পানিতে প্রতিবছর প্রচুর ইলিশ ধরা পড়লেও এ বছর মৌসুমের শুরু থেকে নদ-নদী ও সাগরে মিলছে না কাক্সিক্ষত ইলিশ। লক্ষ্মীপুরে প্রায় ৪০ হাজার জেলের বসবাস। মেঘনা নদী ঘিরেই চলে তাদের জীবন। প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠে এসব জেলে ইলিশ আহরণ করে। আষাঢ়ে বৃষ্টি শুরু হলে সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসতে থাকে নদীতে। এসময় জেলেদের জালে ধরা পড়ে প্রচুর ইলিশ। কেনাবেচায় সরগরম হয়ে মাছের ঘাটগুলো। কিন্তু এবারের চিত্র উল্টো। দিন-রাত খাটুনি করেও জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না ইলিশ। নদীতে মাছ না পাওয়ায় ইলিশনির্ভর উপকূলীয় জেলেদের মুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। দুস্থ এসব জেলের ঘরে তীব্র হচ্ছে দারিদ্র্য।

আটত্রিশ বছরের সুফিয়ান মোল্লা। তিনি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরবংশী গ্রামের জেলে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নদীতে জাল ফেলেছেন। কিন্তু সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে যখন বাড়ি ফিরছেন, তখন দেখেন তার মাছের ডালা প্রায় খালি। চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন তিনি। মাছ না পেয়ে ঘাটে ভিড়ানো নৌকায় গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছেন তিনি। কী ভাবছেন? জিজ্ঞেস করতেই বড় করে একটা দম ফেলে বললেন, কী আর ভাবব ভাই, নদীতে ফসল (মাছ) নাই। সারাদিনে আধা ডালা মাছ মিলে না। কী করুম ভাবতাছি।

তার কথা শেষ হতে না হতেই সত্তরোর্ধ্ব জেলে আলমগীর মাঝি একটি বোলে (সিলভারের থালা) কিছু মাছ নিয়ে হাজির। বললেন, সারাদিনে এক বাটি মাছও মিলে না। আগে এমুন দিনে নদীর পাড় দিয়ে পুঁটিমাছ গড়াইয়া যাইত। সার-কীটনাশক মাছ শেষ কইরা ফালাইছে। এখন নদীতে খালি পানি, মাছ নাই।
জয়নাল-আলমগীর মাঝির মতো মাছ না পাওয়ার আক্ষেপ করলেন জেলে রফিজল, মোকলেছ, সুফিয়ান, হাসেম, আনোয়ার, হাছন আলী, দুদু মিয়া, ছায়দলসহ আরও কয়েকজন। ভর মৌসুমে মেঘনায় মাছ না পাওয়ায় লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় জেলেপল্লীতেও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত জেলেরা। পরিবার-পরিজন নিয়ে কীভাবে জীবন চালাবেন ভেবে তারা কুল-কিনারা পাচ্ছেন না। যাদের কিছু পুঁজি আছে, তাদের কেউ কেউ পুকুরের চাষ করা মাছ শিকার করে বাজারে বিক্রি করে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন।

রামগতি মাছ ঘাটের ব্যবসায়ী মেহেরাজ উদ্দিন জানান, গত বছর এ সময়ে ঘাট থেকে প্রায় দুইশ’ টন ইলিশ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে গেছে। কিন্তু এ বছর মাছ নেই। যে কারণে দুঃসময় চলছে।

মতিরহাট এলাকার জেলেরা জানান, নদীতে মাছ নেই। সারাদিন জাল ফেলে দু’একটি ইলিশও জোটে না। এখন তারা দাদনের দেনা শোধের দুশ্চিন্তায় আছেন।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীর নাব্যতা হ্রাস, পানি দূষণ, ইঞ্জিনচালিত যানবাহন চলাচলসহ নানা কারণে মাছের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস এবং শুকনো মৌসুমে বিল বা ছোট নদী সেচ দিয়ে শুকিয়ে মাছ ধরার কারণে মাছ কমে গেছে। এ ব্যাপারে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে মেঘনা নদীতে মাছ সংকট আরও তীব্র হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একসময় মেঘনা নদীর মাছের ঐতিহ্য ছিল দেশব্যাপী। এ নদীতে সারাবছরই বোয়াল, চিতল, রুই, কাতলা, আইড়, ছোট-বড় খুলি, লাচু, মলা, ঢেলা, পুঁটি, সরপুঁটি, কাইক্যা, গইন্যা, শোল, গজার, পাবদাসহ বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি, বাইম, কৈ, শিং, মাগুর মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। উপজেলার চরবংশী জেলেপল্লী নাইয়াপাড়াসহ উপকূলীয় এলাকায় হাজার হাজার জেলে মেঘনার এ মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। জেলেরা সারাবছর নদীতে মাছ ধরলেও মাছ পাওয়ার মৌসুমকে তারা প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করেন। এর মধ্যে একটি বর্ষার শুরু থেকে মাঝামাঝি এবং অন্যটি শুকনো মৌসুম অর্থাৎ নদীর পানি কমে যাওয়ার শুরু থেকে ফাল্গুন-চৈত্র মাস পর্যন্ত। দুই মৌসুমে নদীতে বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যায়। চলতি মৌসুম অর্থাৎ ভর বর্ষায় ছোট-বড় খুলি, লাচু, মলা, ঢেলা, বাইলা, পুঁটি, সরপুঁটি, কাইক্যা, চিতল, গইন্যাসহ বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি মাছ বেশি ধরা পড়ে। আর শুকনো মৌসুমে পাওয়া যায় বোয়াল, রুই, কাতলা, কৈ, শিং, মাগুর, শোল, গজার, টাকি, টেংরা ও মেনি মাছ। এ মাছের ওপর নির্ভর করেই লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় গড়ে উঠেছে ১৫-২০টি আড়ত। এসব আড়ত ঘিরে মাছ সংরক্ষণের অন্যতম উপাদান ৪০টি আইস ফ্যাক্টরি নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে। যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুরসহ জেলার রামগতির অনেক ব্যবসায়ী মাছ ব্যবসায়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে নদীতে কোনো মৌসুমে পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। চলতি বর্ষা মৌসুমে মেঘনায় মাছ সংকট আরও তীব্র হয়েছে। জেলেরা নদী থেকে ফিরছেন প্রায় খালি হাতে। এতে জেলে পরিবারগুলো ভীষণ আর্থিক সমস্যায় পড়েছে। পরিবারের সদস্যদের দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের ব্যবস্থা করাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যৎ ভাবনায় তারা এখন অস্থির। কারণ তাদের কাছে পর্যাপ্ত পুঁজি নেই, যা দিয়ে তারা অন্য কোনো কাজ করতে পারবেন। আর মাছ শিকার ছাড়া অন্য কোনো কাজও যে জানা নেই তাদের!

চরবংশী নাইয়ারাপাড়া জেলে ও জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির প্রতিনিধি মোস্তফা বেপারি বলেন, মেঘনায় আগের মতো মাছ না থাকার কারণ হলো নদীর নাব্যতা হ্রাস। শুকনো মৌসুমে নদী কোনো কোনো স্থানে একেবারে শুকিয়ে যায়। ফলে মাছের চলাচলের জায়গা কমে যায়। তাই এ সময়ে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে না।
-আতোয়ার রহমান মনির