Sun Mercury Venus Ve Ves
বিশেষ খবর
‘লক্ষী’ থেকে লক্ষীপুর, যার আরেক নাম সয়াল্যান্ড  লক্ষীপুর জেলা পরিষদের উদ্যোগে ৫০ মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা  ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুল শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ  আ’লীগ আবারও ভোট চুরির পরিকল্পনা করছে - লক্ষীপুরে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী  শ্রীলঙ্কার অবস্থা দেখে বাংলাদেশে দিবাস্বপ্ন দেখার কোনো কারণ নেই - লক্ষীপুরে মাহবুব উল আলম হানিফ 

মানবাধিকার কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমী ও সমাজসেবী ফজলুল করিম এর সাক্ষাৎকার

অবরুদ্ধ দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য নিঃস্বার্থভাবে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন। মাতৃভূমি স্বাধীনের পর দেশ গড়ার কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত থেকেছেন; মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য দেশ স্বাধীনের পর মুজিব বাহিনী কর্তৃক শেখ মনি ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব এর স্বাক্ষরিত সনদ পেয়েছেন। ইচ্ছে করেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেননি। প্রিয় পাঠক এতক্ষণ যাঁর কথা বলছি, তিনি হলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী, দেশপ্রেমী ও সমাজসেবী ফজলুল করিম। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর বার্তা পত্রিকার প্রতিনিধি রাজিব গুপ্ত তাঁর সাথে একান্ত আলাপচারিতায় মিলিত হন। তাঁদের আলাপচারিতার উল্লেখযোগ্য অংশ লক্ষ্মীপুর বার্তা’র সহকারী সম্পাদক মোহাম্মদ মোস্তফার অনুলিখনে নিচে সন্নিবেশিত হলো।
লক্ষ্মীপুর তথা বৃহত্তর নোয়াখালীর সন্তান হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে আপনি কেমন অনুভব করেন এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল করিম বলেন, বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করায় মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বৃহত্তর নোয়াখালীর মানুষ পরিশ্রমী, মানুষের সেবায় তারা উদার। তারা যেখানে যে অবস্থানে থাকুক, নিজ এলাকার উন্নয়নে তারা সচেষ্ট থাকে। দেশে গণতন্ত্রের সংগ্রামে, স্বাধীনতা আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর নোয়াখালীর সন্তানরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর আগে সেসময়কার উজ্জ্বল তরুণ নেতা, ডাকসু’র ভিপি, নোয়াখালী তথা লক্ষ্মীপুরের কৃতী সন্তান আ স ম আবদুর রব পাকিস্তানের বুকে প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। যে অনুষ্ঠানে এ পতাকা উত্তোলন করা হয়, আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এ ঐতিহাসিক ঘটনার জন্য আমরা গর্ববোধ করতে পারি।
ফজলুল করিম আরও বলেন ছাত্র-সমাজের ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের সময় যেসব ছাত্র-নেতা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের অন্যতম হলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, যিনি পরবর্তীতে এমপি হয়েছিলেন, তিনি লক্ষ্মীপুরের সন্তান। ছাত্র-ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি সাঈফ উদ্দিন আহমেদ মানিক; ডাকসু’র ভিপি, ছাত্রলীগের সভাপতি ফেরদৌস আহমদ কোরেশী বৃহত্তর নোয়াখালীর ফেনীর সন্তান। ছাত্র-ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ নোয়াখালীর সন্তান; এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য স্থির করে যিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তিনি নোয়াখালীর কৃতী সন্তান সিরাজুল আলম খান-এক রহস্যময় পুরুষ।
রাজনীতির সাথে সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সমাজসেবী ফজলুল করিম বলেন, আমি ঢাকা ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হই। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে; তাঁকে মুক্ত করার জন্য আন্দোলন চলছে। শেখ কামালের সাথে আমার পরিচয়ের সূত্র ধরে ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর ১১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শেখ কামালের নেতৃত্বে আমরা আরো কিছু কর্মী বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে ছাত্রদেরকে সংগঠিত করে মধুর ক্যান্টিন ও বটতলায় মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করতাম। এরই মধ্যে আগরতলা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে আসেন। অনেক লোকের আত্মাহুতি ও প্রবল গণআন্দোলনের চাপে পাকিস্তান সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
’৬৯ সালে শেখ কামাল আমাকে তেজগাঁও কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন। তখন আমি ছাত্রলীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে জিএস পদে নির্বাচিত হই। এসময় অনেক রাজনৈতিক ঘটনার সাক্ষী আমরা। এরপর শুরু হয় ’৭০ সালের নির্বাচন, নির্বাচনে আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জনাব মুহাম্মদ উল্যা এর পক্ষে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনী ক্যাম্পেইন করি এবং ঐ নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।
তিনি বলেন বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসায় নিচতলায় শেখ শহীদ ভাইয়ের রুমে দেশকে পাকিস্তানমুক্ত করার বিষয়ে আমরা কর্মীরা বসে সাংগঠনিক আলাপ-আলোচনা করতাম, বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতাম। শেখ শহীদ পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেকার ঘটনার উল্লেখ করে ফজলুল করিম বলেন ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের সময় আমি মঞ্চের পাশেই ছিলাম, কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছি, আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়েছি। ঐ ভাষণে দেশকে মুক্ত করার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু এতই দৃঢ় ছিলেন যে, সে ভাষণে তিনি ৭ বার ‘ইনশাআল্লাহ’ উচ্চারণ করেছিলেন। এরপর ২৫শে মার্চের বিকেলে আমি অন্যান্য নেতা-কর্মীদের সাথে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছিলাম। রাতে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, এ খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। সে সময়ে সেখানে বিবিসিসহ বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শোনার জন্য। বঙ্গবন্ধু ওদের সামনে এলেন না, তাঁর প্রেস সচিব জনাব আমিরুল ইসলাম আসলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত প্রেসরিলিজ সাংবাদিকদের বিতরণ করলেন।
আমার চাচা ইপিআর এ কর্মরত গোলাম কবির সাহেব ২৫শে মার্চের ৪/৫ দিন পূর্বে আমাকে ইপিআর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যান। সেখানে তিনি বললেন ইপিআর এর পাকিস্তানীরা আমাদের উপর যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ২৫শে মার্চ রাতে তিনি ইপিআর থেকে পালিয়ে আমাদের বাসায় চলে আসেন। পরে তিনিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধে আহত হন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ইপিআর হেড কোয়ার্টার, রাজার বাগ পুলিশ লাইন এবং ইকবাল হলসহ বিভিন্ন স্থানে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এতে আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। এরপর ২৭ মার্চ বিবিসি’র খবরে শুনতে পাই জিয়াউর রহমানের কন্ঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা।
এরপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চে ও পায়ে হেঁটে নিজ এলাকা লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে চলে গেলাম। সেখানে আমরা ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা শুরু করলাম। আমাদের সাথে আলী আশরাফ নামে একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। আমরা ছাত্র-যুবকদের জড়ো করে তাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠাতে শুরু করলাম। কিছুদিন পর বাবা আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসলেন। আমি বাবা-মাকে না বলে আরও কয়েকজন কর্মীর সাথে গোপনে ভারতের আগরতলায় চলে যাই। আগরতলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তখন দায়িত্বে ছিলেন বৃহত্তর নোয়াখালীর তখনকার ছাত্রনেতা মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি পরবর্তীতে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমরা সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে এসেছি দেখে আমাকে মুজিব বাহিনীতে প্রশিক্ষণের জন্য অন্তর্ভুক্ত করেন। এর কিছুদিন পর ট্রেনিংয়ের জন্য দেরাদুনে পাঠাতে আগরতলা বিমানবন্দরে নিয়ে যান। দেরাদুন থেকে প্রশিক্ষিত মুজিব বাহিনীর সদস্যরা বিমানযোগে না আসায় আমাদের আর দেরাদুনে যাওয়া হয়নি। তখন আমাদেরকে আর্মিং হোল্ডিং ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে মোটিভেশনাল ট্রেনিংসহ প্রাথমিক অস্ত্র চালনা শিখানো হয় আমাদেরকে। আমরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নেই। তখন তেজগাঁও কলেজের তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি শহীদ খানের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে ছাত্রনেতা আবদুল কুদ্দুস মাখনের কাছে নিয়ে গেলেন। উনি নিজে আমাদের কয়েকজনকে কয়েকশ’ রাউন্ড গুলি ও একটি এসএমজি দিয়ে হাতিবান্ধা সীমান্তে নিয়ে আসেন এবং বাংলাদেশে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেন। এরপর বাংলাদেশে এসে দাউদকান্দি থেকে নৌকাযোগে শহীদ ভাইয়ের সাথে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এবং শ্রীনগর এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেই। এরপর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর ঢাকায় ফিরে আসি। এসে জানতে পারি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করে লাশ আমার বাসার পশ্চিমে রায়ের বাজারে ইটভাটায় গুম করে রাখা হয়। অনেক লোকের সাথে সেখানে গিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের লাশ দেখতে পাই। সেই নির্মম দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে।
ফজলুল করিম বলেন স্বাধীনতার আগেই তৎকালীন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক, পরবর্তীতে স্পিকার ও রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ছাত্রলীগের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। এছাড়া তিনি লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। সে সুবাদে ওনার সাথে থেকে এলাকার উন্নয়নমূলক ও জনসেবামূলক বিভিন্ন কাজে লক্ষ্মীপুরের মানুষের সাথে কাজ করেছি। এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছি। বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের এক পর্যায়ে ক্ষমতায় এলেন জেনারেল এরশাদ সাহেব। তিনি শাসন-ব্যবস্থায় কিছু সংস্কার করলেন, প্রবর্তন করলেন উপজেলা পদ্ধতি। সাবেক থানাগুলোকে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হলো। আমি ভাবলাম, এ পদ্ধতির সাথে সম্পৃক্ত হলে মানুষের জন্য কিছু কাজ করতে পারব। আমি নিজ এলাকা রায়পুর উপজেলায় কাজ শুরু করলাম। আমি উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হলাম। সাধারণ ভোটারদের আমার উপর আস্থা ছিল। আমার সমর্থক ভোটাররা আমাকে ভোট দিলেন, কিন্তু তৎকালীন টিএনও মনসুর ফলাফল জালিয়াতি করে আমার বিজয় ছিনিয়ে নেয়। আমি নির্বাচনে কারচুপির বিরুদ্ধে মামলা করলাম। মামলার রায়ে নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করা হয়। মাটি ও মানুষের উপর আমার প্রবল আস্থা সবসময় আছে; আমি পরবর্তীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সেই প্রার্থীকে ১৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করি। উল্লেখ্য যে, ২য় বার নির্বাচনের পূর্বে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রায়পুর যান। সেখানে রায়পুর মৎস্য হ্যাচারীতে নেতা-কর্মীদের সামনে বিএনপিতে যোগ দিয়ে নির্বাচন করার জন্য আমাকে বলেন। তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জাতীয় পার্টি। আমি ম্যাডামকে বিনয়ের সাথে বলি নির্বাচনের পূর্বে বিএনপি-তে যোগ দিলে আমার অনেক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তখন তিনি বিএনপি’র সকল নেতা-কর্মীগণকে আমার পক্ষে নির্বাচন করার জন্য বলেন।
ফজলুল করিম বলেন আমি এলাকায় আছি, এলাকায় থাকব। এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সক্ষার সাথে আমি এখনও জড়িত আছি। তাদের সাথে আমার রয়েছে নিয়মিত যোগাযোগ। শিক্ষা উন্নয়নে, স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে আমি কাজ করে যাচ্ছি।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হলো, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবী ফজলুল করিম বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখানে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপূর্বে যারা আন্দোলনের শীর্ষে ছিলেন, তাদের অধিকাংশই বৃহত্তর নোয়াখালীর সন্তান। তাদের নেতৃত্বে আন্দোলনের গতিপথ সুনির্দিষ্ট হওয়া এবং এক্ষেত্রে নিউক্লিয়াস সৃষ্টি হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ সঠিক পথে এগিয়ে গেছে। বিশ্বের অন্যান্য মুক্তিসংগ্রামের তুলনায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি বলেন, ছাত্রলীগ সেসময় দুর্দান্তভাবে কাজ করেছে; তারা সময়োপযোগী দায়িত্ব পালন করেছিল বলেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা সহজ হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তা আমরা সম্পূর্ণ পূরণ করতে পারিনি। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। আমরা জনগণের কাছে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম, কিন্তু তা আজও কায়েম হয়নি। একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা থাকেনি। এরপর সামরিক শাসন, আধা সামরিক শাসন এভাবে চলতে চলতে বর্তমানেও সংসদীয় গণতন্ত্র পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করতে পারেনি। এজন্য অনেক সমস্যায় জাতিকে নিপতিত হতে হচ্ছে। রাজনীতি সঠিক পথে পরিচালিত না হবার কারণে পেশাদার রাজনীতিকরা রাজনীতির মাঠ ছেড়ে দিচ্ছেন; যার ফলে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত লোকের দখলে দিন দিন রাজনীতির মাঠ চলে যাচ্ছে। রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে না পারলে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র সঠিকভাবে চালু হলে দেশ অনেক জটিলতা থেকে মুক্ত হবে। আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়নে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, দেশে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দুভাগে বিভক্তি করা হয়েছে। স্বাধীনতার এতবছর পরেও এই ইস্যু নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। এক সরকারের আমলে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে, সরকার পরিবর্তনের পর নতুন সরকার তা মানে না। এভাবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বার বার পরিবর্তন হচ্ছে। দুঃখ ও লজ্জার বিষয় যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদর, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী অনেকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। সাধারণ মানুষ এসব দেখে ব্যথিত হয়েছে। কারণ তাদের কাছে অনেক তথ্যই জানা আছে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আমার নাম থাকবে, আমি সুযোগ-সুবিধা পাব -এজন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। এসব দেখে আমি রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। মানুষের জন্য, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবাধিকার নেতা ড. মোহাম্মদ শাহজাহান আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন সক্রিয়ভাবে কাজ করতে। মানবাধিকার ব্যুরোর পক্ষে পৌরসভার মেয়রসহ নির্বাচিতদের নিয়ে শহরের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও দুষণমুক্ত করার জন্য সচেতনতা কর্মসূচি বাস্তবায়নের কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
এছাড়াও ইতোমধ্যে এলাকায় সমাজসেবামূলক কিছু কাজ শুরু করেছি। বিনামূল্যে গাছের চারা বিতরণ করে সবুজ-আন্দোলনকে প্রসারিত করার কাজ করছি। উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের পোনা অবমুক্তকরণ ও দরিদ্র মৎস্য চাষীদের বিনামূল্যে মাছের পোনা বিতরণ করে মৎস্য চাষকে উৎসাহিত করে আসছি। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থার জন্য দায়ী হলো ধনী দেশগুলো, কিন্তু তারা বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণ বা আর্থিক সাহায্য করে না। বাংলাদেশে বনায়ন কর্মসূচি ব্যক্তিগত পর্যায়ে শুরু হলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারব।
তিনি বলেন, সংস্কার আন্দোলন ও কল্যণমূলক কর্মকান্ডে যুক্ত থেকে মানবাধিকারের কাজও করছি। রায়পুরে নতুন ধারার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছি। ৩৫ জন সমমনা লোককে নিয়ে রায়পুরে ১ কোটি টাকা ব্যয়ে রায়পুর মা ও শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছি, সেখানে চিকিৎসার আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটি স্বাস্থ্যসেবায় অবদান রাখছে। তবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ডাক্তার না পাওয়ার কারণে প্রতিমাসে লক্ষাধিক টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এরপরও মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিতে তা চালিয়ে যাচ্ছি।
বৃহত্তর নোয়াখালীর মুখপত্র লক্ষ্মীপুর বার্তা’র মূল্যায়ন এবং এ পত্রিকার উন্নয়নে পরামর্শ রেখে মানবাধিকার কর্মী ফজলুল করিম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসিতে লক্ষ্মীপুর বার্তা’র একটি বৈঠকের কথা আমার মনে পড়ে। সেখানে কাজী ফারুকী, এম হেলাল ছিলেন। হেলাল সাহেবের সাথে আমার আলাপ হয়। এরপর থেকে আমি নিয়মিত লক্ষ্মীপুর বার্তা পড়ে যাচ্ছি। এর বিভিন্ন লেখা, উন্নয়ন-সমস্যা ও উন্নয়ন-সম্ভাবনার ওপর লেখা পড়ছি, বৃহত্তর নোয়াখালীর কৃতী সন্তানদের সাক্ষাৎকার-প্রতিবেদন পড়ছি। লক্ষ্মীপুর বার্তা’র প্রকাশনা উন্নত মানের, আঞ্চলিক নামধারী হলেও লক্ষ্মীপুর বার্তা জাতীয় পর্যায়ের পত্রিকা হিসেবে গৃহীত হবার যোগ্যতা রাখে। সত্যিকারভাবে লক্ষ্মীপুর বার্তা বৃহত্তর নোয়াখালীর দর্পণ। আমি আশা করি, লক্ষ্মীপুর বার্তা’র সম্পাদক ড. এম হেলাল তাঁর গবেষণার মাধ্যমে আরও নতুন নতুন কলাম সংযোজন করবেন, লেখালেখির মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের নজরে আনবেন এ অঞ্চলের সমস্যার কথা, তুলে ধরবেন নানামুখী সম্ভাবনার চিত্র। আমি লক্ষ্মীপুর বার্তা’র উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।
তিনি বলেন লক্ষ্মীপুর বার্তা’র উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মীপুর বার্তা ফাউন্ডেশন এর আয়োজনে লক্ষ্মীপুরের গুণীজনদের সম্মানিত করা হয়েছে, বৃহত্তর নোয়াখালীর গুণীদের সম্মাননার ঘেষণা দেয়া হয়েছে। এটি একটি বিশাল কর্মকান্ড, যা অন্যদের জন্যও অনুকরণীয়।