শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-বাণিজ্য ও সমাজসেবায় লক্ষ্মীপুর বাংলাদেশের মধ্যে একটি উজ্জ্বল নাম - ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া

নিজ জন্ম-এলাকা সম্পর্কে অনুভূতি এবং শৈশব স্মৃতির কথা জানতে চাইলে এলাকাপ্রেমী নিবেদিত সমাজকর্মী ফরিদ আহমদ ভূঁইয়া বলেন, আমি লক্ষ্মীপুরের একটা অজ পাড়াগাঁয়ের সন্তান। যেখানে বড় হয়েছি, সেখানে রাস্তা ছিল না; শুকনো মৌসুমে হাঁটাচলা করা সম্ভব হলেও বর্ষায় ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে পারাপার করতে হতো। এছাড়া ছিল তালের ডোঙা নৌকা, যা ছিল যাতায়াতের অন্যতম বাহন। সাথে একটা গামছা থাকতো, লুঙ্গি খুলে ওটা পরে খাল পার হতাম। গ্রামের সহপাঠীরা মিলে অন্যের বাড়িতে গিয়ে ইচ্ছেমতো টসটসে রসে ভরা কালো জাম খেতাম। গাছের মালিক কিছু বলত না। এখন সেসব স্থানে রাস্তাঘাট হয়েছে, অনেক উন্নতি হয়েছে। রিক্সা-ভ্যানগাড়ি দিয়ে স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে পারছে। গ্রামের মানুষ এখন আর বেকার নেই, তারা কিছু না কিছু করছে। গ্রামের দোকানগুলোতে টিভি চালিয়ে গ্রাহক আকৃষ্ট করার চেষ্টা চলছে; এতে কাজও হচ্ছে। দোকানীদের দোকানে প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। পনেরো বছরের আগেকার গ্রামেরও সাবেক চেহারা এখন নেই, মানুষের চিন্তাধারায়ও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
নিজ এলাকার সাথে কীভাবে যোগাযোগ রক্ষা করেন এমন প্রশ্নে জনদরদী প্রাণোচ্ছল মানুষ ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, নিজ এলাকার সাথে এখনও নিয়মিত যোগাযোগ আছে। এলাকার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-এতিমখানা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় যুক্ত রয়েছি। বাবা বলে গেছেন, গ্রামের মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় তোমাদের লেখাপড়া হয়েছে, সবসময় তাদের পাশে থাকবে, তাদের ঋণ কিছু হলেও শোধ করার চেষ্টা করবে। কারণ আমার বাবা মরহুম ডাঃ মফিজ উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া হোমিও প্যাথির ওপর কুমিল্লা হোমিওপ্যাথি কলেজ থেকে ১ম ব্যাচে ডিপ্লোমা করে সরাসরি গ্রামে চলে যান এবং আজীবন ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত থেকে মানুষের সেবা করেছেন। বাবার সে কথা ভুলিনি, তাই বার বার ফিরে যাই জন্মস্থানের ঠিকানায়। আমাদের সব ভাই-বোনের পড়ালেখার ক্ষেত্রে গ্রামের মানুষের অশেষ অবদান ছিল, তা আমরা সবসময় মনে রাখি।
লক্ষ্মীপুরের সন্তান হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে কেমন অনুভূতি হয় আপনার এমন প্রশ্নে এলাকাপ্রেমী, মানবদরদী ব্যক্তিত্ব ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, লক্ষ্মীপুরের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। আমার জন্ম এমন একটা জেলায় হয়েছে, যেখানকার মাটি ধন্য হয়েছে অনেক জ্ঞানী-গুণী, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী, প্রথিতযশা রাজনীতিককে জন্ম দেয়ার মাধ্যমে।
নিজ এলাকার প্রধান সমস্যা এবং তার সমাধানের ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী এমন প্রশ্নে এলাকাপ্রেমী সমাজসেবী ব্যক্তিত্ব ফরিদ আহমদ ভূঁইয়া বলেন, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতিই লক্ষ্মীপুরের বড় সমস্যা। উন্নতি যা-ই হোক, দু’মুঠো খেয়ে শান্তিতে ঘুমাতে পারলে মানুষ অনেক সন্তুষ্ট থাকে। যুব-সমাজের মধ্যে বেকারত্বের যন্ত্রণা আছে, বিনোদন বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হবার সুযোগ নেই; খেলার মাঠ নেই, যাতে যুক্ত থাকলে খারাপ কাজ কিংবা চিন্তা থেকে সরে থাকা যায়। যুবশক্তিকে সঠিকভাবে সংগঠিত এবং পরিচালিত করতে পারলে সামাজিক সমস্যার মোকাবেলা সম্ভব হবে।
বৃহত্তর নোয়াখালী বর্তমানে লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও নোয়াখালী -এ তিন জেলায় বিভক্ত; এ তিন জেলার মধ্যে কীভাবে ঐক্যের স্পিরিট ধরে রাখা যায় বলে মনে করেন এমন প্রশ্নে বৃহত্তর নোয়াখালীর কৃতী সন্তান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘আঞ্চলিক উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন’ -এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হচ্ছে নোয়াখালীর মানুষ। নোয়াখালীর মানুষের ফেলো-ফিলিংস কিংবদন্তীতুল্য। কোনো অবস্থাতেই এটি নষ্ট হবার নয়। বৃহত্তর নোয়াখালী যে সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত -তার পাশের অন্য জেলাতেও নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা, কালচার কার্যকর রয়েছে। আচার-ব্যবহার, সংস্কৃতি, এমনকি বৈবাহিক সম্পর্কও সহজে স্থাপন করা হচ্ছে। আঞ্চলিক ভাষা এবং কালচারের ভিত্তিতে চিন্তা করলে নোয়াখালী বেশ বড় জেলা। এর ঐক্যের স্পিরিট অতীতে যেমন ছিল, ভবিষ্যতেও তেমনি অটুট থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
বৃহত্তর নোয়াখালীতে শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রগতিশীল শিল্পপতি ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, নোয়াখালী থেকে ৬৮ কিঃ মিঃ দূরে সমুদ্র; সমুদ্র বক্ষ থেকে একটি বিশাল ভূখন্ড জেগে উঠছে, যা ঠিকমতো গড়ে নিতে পারলে প্রায় আরেকটা বাংলাদেশ গড়ে তোলা যাবে। কাজেই নতুন সমুদ্র বন্দর নোয়াখালীতে স্থাপন হতে পারে। এখানে শিল্পস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমির সহজ প্রাপ্তি, নতুন বন্দরের নৈকট্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সহজে আকৃষ্ট করবে। বৃহত্তর নোয়াখালীতে দক্ষ, আধা দক্ষ, অদক্ষ প্রচুর শ্রমিক রয়েছে; নতুন শিল্প স্থাপনে এটিও একটি সহায়ক উপাদান।
নোয়াখালীতে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার যে সুযোগ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, তা আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
বৃহত্তর নোয়াখালীতে রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) স্থাপনের সম্ভাবনা সম্পর্কে এ অঙ্গনের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ফরিদ আহমদ ভূঁইয়া বলেন, টাকা থাকলেই ইন্ডাস্ট্রি করা যায় না। ইন্ডাস্ট্রি করতে গেলে Brain, Money, Land & Labour অপরিহার্য। এরপর গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। লক্ষ্মীপুরে মেঘনার জলপ্রবাহ থেকে কাপ্তাইয়ের মতো জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় কিনা, তা ভাবতে হবে। সার্বিক বিবেচনায় বৃহত্তর নোয়াখালীর কয়েকটি স্থান ইপিজেড স্থাপনের উপযুক্ত।
বৃহত্তর নোয়াখালীর অনেক শিল্পপতি রয়েছেন, যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে শিল্প স্থাপন করেছেন, অথচ নিজ এলাকায় শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসেননি -এর কারণ কী? নিজ এলাকায় শিল্প স্থাপনে এদেরকে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করা যায় এমন প্রশ্নে আধুনিক ধ্যান-ধারণার শিল্পপতি ব্যক্তিত্ব ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, আগে মতিঝিল ছিল কমার্শিয়াল এরিয়া, এখন গুলশান হয়েছে কমার্শিয়াল এরিয়া। পরিবেশ সবসময় একভাবে থাকছে না; ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এসব হচ্ছে, সরকার করে দিচ্ছে না। নোয়াখালীতে শিল্প-কারখানা করতে গিয়ে দেখা যাবে এখনও ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, গ্যাসের লাইন এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তাঘাট অপ্রশস্ত, ভারি যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী। কাজেই শিল্প স্থাপনে উদ্যোক্তাগণ ভরসা পান না।
আগে শিল্প স্থাপনের পথে এসব অন্তরায়-অসুবিধা দূর করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা হবে প্রধান। প্রত্যেক মানুষেরই নিজ এলাকার প্রতি টান আছে। সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলে তারা অবশ্যই যাবেন। যেমন আমি যাচ্ছি পিতার আদেশ শিরোধার্য করে। নিজ গ্রামে একটি কলেজ করতে যাচ্ছি, পরিবারের সদস্যদের ইচ্ছানুসারে এর নাম দেয়া হয়েছে ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া স্কুল এন্ড কলেজ, ক্যাডেট কলেজের স্টাইলে এর শিক্ষা ও অন্যান্য কার্যক্রম চলবে। সাড়ে সাতশত ছেলেমেয়ের একোমোডেশনের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে ৩৫০ জন শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ খরচ দিয়ে পড়ানো হবে। উক্ত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকাকালীন সময়ে এলাকার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক মহোদয়দেরকে বিবিধ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হবে। একজন সাবেক আর্মি অফিসারকে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব দেয়া হবে। তবে বৃহত্তর নোয়াখালীর শিল্পায়নের ব্যাপারে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণে সেমিনার-সিম্পোজিয়ার মাধ্যমে সবার মতামত নেয়া প্রয়োজন। আশা করি, এ ব্যাপারে অনীহার বরফ গলবে। উদ্যোক্তাগণ ধীরে ধীরে এলাকায় শিল্পস্থাপনে আগ্রহী হবেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এমন কোনো স্মৃতি মনে আছে কী, যা আজও আপনার মনে দোলা দেয় এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় ছিলাম। একবার আমরা ক’জন মুক্তিযোদ্ধা সোনাইমুড়ি থেকে ভারতে যাওয়ার পথে বজরা নামক স্থানে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর সাথে আমাদের সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়। হঠাৎ আক্রান্ত হওয়ায় আমরা এদিক-ওদিক ছিটকে পড়লাম। আমি নিজেও দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জলাশয়ে পড়লাম। ভাবলাম সাঁতরে ওপারে গিয়ে উঠব। আমার সাথে অস্ত্র, এ অবস্থায় সাঁতার কাটা সহজ নয় জেনেও জীবনের তাগিদে পানিতে ঝাঁপ দিলাম। আমি প্রায় ডুবেই গিয়েছিলাম। এ সময় মানুষের কথা শুনতে পেলাম। আমিও বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। কিন্তু কেউ বাঁচাতে এল না, ফলে বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। তবু শেষ বারের মতো গলা চড়িয়ে চিৎকার দিলাম। আসলে ওরা ছিল জেলে, ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত ছিল। তারা নৌকা নিয়ে আসল, আমাকে উদ্ধার করল। কোনোমতে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সবাই আবার মিলিত হলাম। আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ছোত্তা খোলা ক্যাম্প এলাকায় প্রবেশ করলাম। মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে ফিরে আসার সে ঘটনার কথা এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসতেও সক্ষম হয়েছেন; যে চেতনা নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, দীর্ঘ ৪৪ বছর পর সেই চেতনার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, বাস্তবায়ন অনেকটাই হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে, কৃষিতে উন্নতি হয়েছে, গার্মেন্টেস এ দেশ বেশ এগিয়ে গেছে। বড়-মাঝারি-ছোট আকারের অনেক শিল্প স্থাপন করেছেন দেশীয় উদ্যোক্তাগণ। বড় বড় হোটেল গড়ে উঠেছে, আমাদের পর্যটন সমৃদ্ধ হচ্ছে, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তবে বাংলাদেশের এ অগ্রগতিকে বিশাল কিছু ভেবে আত্মপ্রসাদের সুযোগ নেই। স্বাধীনতার পরপরই মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে সর্বদলীয় সরকার গঠনের দাবি জানানো হয়েছিল। তখনকার অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে বৃহত্তর জাতীয় ঐকের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। সামাজিক বৈষম্য দূর করাই ছিল এর লক্ষ্য। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা সে পথে যেতে পারিনি।
ব্যবসায়ে সম্পৃক্ত হবার প্রেক্ষাপট জানতে চাইলে সফল ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, আমাদের ৮ ভাই ৪ বোনের বিরাট পরিবার। চাকরির মাধ্যমে অর্জিত আয় দিয়ে বড় পরিবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল না। সেজন্যই ব্যবসায়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের সিদ্ধান্ত নিলাম। ব্যবসায়ে সফলতার জন্যে আমি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে জীবনযুদ্ধে নেমেছিলাম। তিনি বলেন, ব্যবসায় বা কর্মজীবনে আমি দু’নম্বরী কোনো কাজ করিনি, জানা মতে কোনো ভুল বা অন্যায় করিনি।
সমগ্র দেশ, বিশেষ করে ঢাকা শহরের যানজট সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিশ্রুতিশীল ব্যবসায়ী-ব্যক্তিত্ব, দূরদর্শী সমাজ চিন্তাবিদ ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, সুযোগ থাকলেও ঢাকা শহরের উন্নয়ন আশানুরূপ হয়নি। কারণ ঢাকার উন্নয়নে কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত নেয়া হয়নি। যেখানে শহর, সেখানে বাণিজ্য। তবে বাণিজ্যও একটা নিয়মনীতির মধ্যদিয়েই চলবে -এ ধারণাটা সবার কাছে পরিষ্কার নয়। আমরা যে যেখানে পারছি, দোকান বসাচ্ছি। একবারও ভাবছি না এর জন্যে রাস্তায় যানজট হচ্ছে, মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, যেখানে-সেখানে মার্কেট নির্মাণও ঠিক নয়। এ বিষয়গুলো যতদিন আমরা ঠিক করতে না পারব, ততদিন ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্যই থেকে যাবে।
তিনি বলেন, যানজটে পড়ে কর্মচঞ্চল ঢাকা শহর স্থবির হয়ে যায়। এতে প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। আমরা যদি আরও আন্ডারপাস, ফ্লাইওভার দ্রুততার সাথে নির্মাণ করতে পারি, মার্কেট নির্মাণে সতর্ক হতে পারি, ফুটপাতে দোকান বসাতে না দেই -তাহলে রাস্তায় যানচলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসবে; অর্থ, সময়, শ্রম সর্বক্ষেত্রে আমাদের সাশ্রয় হবে।
উন্নত আইন-শৃঙ্খলা পরিবেশের ওপর দেশের উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভরশীল; দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসার জবাবে আশাবাদী মানুষ ব্যবসায়ী সমাজের নেতা ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ যথেষ্ট তৎপর; জঙ্গী-দুষ্কৃতকারী দমন ও নির্মূলে তাদের সাফল্যও উল্লেখযোগ্য। তবু তাদের গতিকে আরও তীব্র করে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে হুমকিস্বরূপ সন্ত্রাসী জঙ্গিদের নির্মূল করতে হবে।
সর্বগ্রাসী দুর্নীতি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুর্নীতি সমাজে শাখা-পল্লবে বিস্তারলাভ করেছে; সম্পূর্ণরূপে এর মূল্যোৎপাটন সম্ভব না হলেও একে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন নয়। সরকারের অফিস-দপ্তরগুলো ডিজিটাল হয়ে গেলে দুর্নীতির সুযোগ সীমিত হয়ে যাবে। তবে সন্ত্রাস দমনের মতো দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রেও সরকারকে জিরো টলারেন্সে থাকতে হবে।
একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে ছাত্র-রাজনীতি এবং জাতীয়-রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন জানতে চাইলে সমাজ সচেতন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন ছাত্র-সমাজ ছিল আশা-ভরসা স্থল, কিন্তু তারা তাদের ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখতে পারেনি। নিজেদের আদর্শ থেকে সরে গেছে, এখন তাদের কাছে ব্যবসায়িক লক্ষ্য বড় হয়ে ফুটে ওঠে। রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, তার গণমুখী চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। এটি ছাত্র-রাজনীতিকেও বিষাক্ত করে তুলছে।
বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে যুবশক্তির উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন এমন প্রশ্নে আধুনিক ধ্যান-ধারণার অনুসারী ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে সরকারকে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া সরবরাহ, ল্যাবরেটরির উন্নয়ন এবং লাইব্রেরিতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই সরবরাহ করতে হবে। পাশাপাশি এগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কিনা, তা মনিটরিং করতে হবে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ইন্টারনেট আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে যুব-সমাজের স্বকর্মসংস্থানে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছে; বাংলাদেশে এক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন এমন প্রশ্নে ব্যবসা-জগতের সফল ব্যক্তিত্ব ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, কল-সেন্টারের মাধ্যমে তরুণদের তথ্য-প্রযুক্তিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে আউট সোর্সিং ইনকাম অবিশ্বাস্য রকম বাড়ানো যায়। এক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে আমাদের তরুণদের Potentiality কোনো অংশে কম নয়।
আপনি ঢাকাস্থ লক্ষ্মীপুর জেলা সমিতির সভাপতি, এ সংগঠনের কার্যাবলিতে গতিশীলতা আনায়নে আপনার কী কোনো পরিকল্পনা রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, আমরা এখনো বিশেষ কিছু করতে পারিনি। একটা জায়গা কিনেছি, সেটার ওপর ৬ তলা একটা বিল্ডিং করেছি। গরিব-মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি দেয়ার প্রকল্প আজও বাস্তবায়িত করতে পারিনি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তা শুরু করা হবে বলে আশা করছি।
রামগতি ও কমলনগরের নদীভাঙ্গন রোধে কী কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এমন প্রশ্নে এলাকাপ্রেমী সমাজসেবী ব্যক্তিত্ব ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, রামগতি ও কমলনগর উর্বরা মাটির এলাকা। দেশের খাদ্যশস্য ভান্ডারে এ দু’টি এলাকা প্রতি মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ শস্য জমা করছে। এছাড়া এ এলাকায় বেসরকারি পর্যায়ে ইকোনোমিক জোন স্থাপনের সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। এসব কারণে রামগতি-কমলনগরের ভাঙ্গন রোধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারের কিছু উদ্যোগ প্রশংসনীয়, তবে এ উদ্যোগ আরও বলিষ্ঠ ও ব্যাপক হতে হবে।
বৃহত্তর নোয়াখালীতে ইকোনোমিক জোন গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লাখো জনতার সমাবেশে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, নোয়াখালীতে ইকোনোমিক জোন বা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। তাঁর সেই আশা জাগানিয়া ঘোষণার পরতো অনেকদিন কেটে গেল, কিন্তু এ ব্যাপারে নড়চড় দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে প্রগতিশীল ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়ার মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলাকার বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্য উভয়ে মিলে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে, আলাপ-আলোচনা করে বিষয়টি তাঁর সুনজরে আনা প্রয়োজন। বৃহত্তর নোয়াখালীর উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট আগ্রহ আছে। এখন তাঁকে বিষয়টির জরুরি প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানাতে হবে। ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠিত হলে শিল্পে-বাণিজ্যে নোয়াখালীর অগ্রগতি হবে অভূতপূর্ব, অভাবনীয়। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়ায় নোয়াখালীর মানুষ আশান্বিত হয়ে উঠেছে যে, এবার তাদের ভাগ্য খুলবে। কারণ চট্টগ্রাম জেলা ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে কাছের জেলা হলো বৃহত্তর নোয়াখালী। ৪ লেন সড়ক নির্মাণ সম্পন্ন হলে নোয়াখালী থেকে দেড়ঘন্টায় চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানো যাবে। নোয়াখালীতে দক্ষ, আধা দক্ষ, অদক্ষ শ্রমিক রয়েছে অনেক। বৃহত্তর নোয়াখালীর সন্তান অনেক শিল্পপতি রয়েছেন, যাঁরা ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবেন। এ ব্যাপারে শিল্প ও ব্যবসায় জগতের প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে তাদের সুচিন্তিত মতামত পেশ করতে পারেন। আমি আশাবাদী যে, বৃহত্তর নোয়াখালীতে ২/৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব।
বৃহত্তর নোয়াখালীর মুখপত্র লক্ষ্মীপুর বার্তা’র মূল্যায়ন প্রসঙ্গে লক্ষ্মীপুর জেলা সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, আমার প্রিয় পত্রিকা লক্ষ্মীপুর বার্তা। দীর্ঘদিন উন্নত প্রকাশনায় প্রকাশিত হয়ে আসছে -এটি আমাদের গৌরবের বিষয়। বৃহত্তর নোয়াখালী, বিশেষ করে লক্ষ্মীপুরের কৃতী সন্তানদের পাঠকদের সামনে তুলে ধরছে এ পত্রিকা। ব্যক্তিত্বগণ নিজ এলাকার মানুষের সাথে পরিচিত হচ্ছেন, এলাকার মানুষের কাছাকাছি আসতে পারছেন। বৃহত্তর নোয়াখালী বিশেষ করে লক্ষ্মীপুরের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা কর্তৃপক্ষের নজরে তুলে ধরছে লক্ষ্মীপুর বার্তা। আমি এ পত্রিকার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।